বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : এবার সরাসরি এক সময়ের দলনেত্রীর দিকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন প্রাক্তন। বৃহস্পতিবার গোটা কাঁথি ছিল শুভেন্দু–ময়। কী পদযাত্রা, কী জনসভা, শুভেন্দুর জয়ধ্বনি শোনা গিয়েছে সর্বত্র। ছিল সকলের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ততা। যা দেখে অনুপ্রাণিত স্বয়ং শুভেন্দু। তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে বলেই দিলেন, ‘বিজেপিই ক্ষমতায় আসছে। আসবেই। তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে সরতে হবেই। আমি এখান থেকে আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেলাম। দেখবেন, নির্বাচনের ফল কী হয়! তার পর ১০ বছরের জন্য আপনাকে এবং আপনার দলকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে। সেই প্রস্তুতি নিন এখনই।’
এদিন কাঁথিতে শুভেন্দুর কর্মসূচি শুরু হয় পদযাত্রা দিয়ে। সেই পদযাত্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সাংসদ সৌমিত্র খাঁ এবং রাজ্য নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার। কাঁথির ইতিহাসে এমন গেরুয়া স্রোত আগে কখনও কেউ দেখেননি। বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তা সর্বত্র ছিল গেরুয়া পতাকায় ছয়লাপ। উল্লেখ্য, বুধবার কাঁথিতে ছিল তৃণমূলের সভা। সেখানে তৃণমূলে থাকলেও অধিকারীবাড়ির কোনও সদস্যই ছিলেন না। ছিলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও বিধায়ক অখিল গিরি। জনসভায় মানুষের ভিড়ও হয়েছিল ভালোই। যা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীরা। কিন্তু বৃহস্পতিবার পালটা কর্মসূচি নেন শুভেন্দু। কাঁথি–মেচেদা বাইপাস থেকে এদিন বেলা ৩টেয় শুরু হয় পদযাত্রা। কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথ যাওয়ার কথা ছিল ২ ঘণ্টায়। কিন্তু পদযাত্রায় এত ভিড় হয়েছিল যে, নির্ধারিত সময়সূচি সেভাবে মেনে চলা যায়নি। শেষে কাঁথি বাসস্ট্যান্ডের কাছে মাঠে হয় জনসভা।
কাঁথির রাস্তা দিয়ে শুভেন্দুর মিছিল এগোনোর সময় দু’পাশের বাড়িগুলি থেকে ফুল ছুড়তে থাকেন মহিলারা। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর কাঁথিতে শুভেন্দুর ডাকে প্রথম সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল এদিন। আর সেই কর্মসূচিতে তিনি দেখিয়ে দেন নিজের ক্ষমতা। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর কর্মসূচিতে এদিন ছিল জনজোয়ার। জনপ্লাবনে রীতিমতো ভেসেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। মিছিল থেকেই ফের একবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান তিনি। তিনি বলেন, ‘২০১১ সালের আগে তৃণমূলকে দেখা যেত না। ২০১১ সালের আগে জুনপুরে পদযাত্রায় তারা ছিল না। শুধু বক্তৃতা করেই চলে যেত।’ এর পরই তিনি নিশানা করেন পুলিশ ও প্রশাসনকে। বলেন, ‘শুনে রাখুন, বিজেপিই ক্ষমতায় আসছে। তার পর ১০ বছর কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে থাকতে হবে।’ বুধবারের জনসভায় তৃণমূলের হয়ে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম তাঁর বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ ভাষা ব্যবহার করে তোপ দেগেছিলেন।
এদিন তারই জবাব দেন শুভেন্দু। ফিরহাদ হাকিমকেও এক হাত নেন। বলেন, ‘উপনির্বাচনে টিকিট পাননি বলে মমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।’ শুভেন্দু এ কথাও বলেন, ‘কলকাতাকে যিনি মিনি পাকিস্তান বলেছিলেন, তিনি কিনা আমাকে বুধবার নীতিশিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন!’ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে উল্লেখ করে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে যা নয়, তা–ই বলেছিলেন। বৃহস্পতিবার তার পাল্টা দেন শুভেন্দু। তবে যথেষ্ট সংযত ভাষায়। বলেন, ‘আর কয়েক মাস মাত্র। একটু অপেক্ষা করুন। সামনের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে ২০০ আসনে জিতবে বিজেপি।’ সৌগতবাবুর মুখেও নীতির কথা মানায় না বলে জানান শুভেন্দু। বলেন, ‘১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন এই সৌগত রায়ই। তখন নীতিকথা মনে ছিল না! সব ভুলে গিয়েছেন নাকি?’ এর পরই তিনি তোলেন ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি।
এদিন শুভেন্দুর মিছিল এবং জনসভায় তাঁর পরিবারের কেউ ছিলেন না। থাকার কথাও নয়। কারণ, তাঁরা তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি। তার পর নিজের বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে টেনে আনেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর সম্পর্কে নিজের ধারণার কথা বললেন একেবারে সরাসরি। বললেন, ‘আমার কিন্তু ভাইপো নিয়ে সমস্যা নেই। আমার সমস্যা হল তোলাবাজ ভাইপোকে নিয়ে।’ বুধবার কাঁথিতে সৌগত রায়, ফিরহাদ হাকিম–সহ তৃণমূল নেতারা শুভেন্দুকে আক্রমণ করতে গিয়ে গোটা অধিকারী পরিবারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। যদিও শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী এবং ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী এখন তৃণমূলের সাংসদ। এমনকী, ছোট ভাই সৌম্যেন্দু অধিকারীও কাঁথি পুরসভায় তৃণমূলের চেয়ারম্যান। তৃণমূল নেতারা এই বিষয়টি যে বোঝেন না, তা নয়। হয়তো জেনে বুঝেই বলেছেন।
সৌগত রায় বলেছেন, ‘কাঁথি শহর কোনও পরিবারের জমিদারি নয়।’ এই আক্রমণ বাড়িতে বসেই শুনেছেন তৃণমূলেরই প্রবীণ সাংসদ শিশির অধিকারী। অবার মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘শুভেন্দু এতদিন যে আমার সহকর্মী ছিল, সে কথা ভাবতেও লজ্জা হয়!’ এই তোপ শুনেছেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীও। এ–সব আক্রমণ যে তাঁদের ভালো লাগবে না, তা সহজেই অনুমেয়। ঘনিষ্ঠ মহলে সে কথা জানিয়েও দিয়েছেন শিশির অধিকারীও। নিজের দুঃখিত হওয়ার কথাও বলেছেন। তবে দিব্যেন্দু দুঃখিত হননি, রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সেখানেই থেমে থাকেননি তৃণমূল নেতারা।
শুভেন্দু তথা অধিকারী পরিবারকে শিক্ষা দিতে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভা ৭ জানুয়ারি হবে বলে ঘোষণা করেন। এদিন তার জবাবও দেন শুভেন্দু। জানিয়ে দেন, তার পরের দিন ৮ জানুয়ারি তিনি নন্দীগ্রামে জনসভা করবেন। সূত্রের খবর, দুটি সভাই ৭ তারিখ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একই জায়গায় একই দিনে দুটি জনসভা হলে আইনশৃঙ্খলার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। তাই প্রশাসনের অনুরোধে নিজের জনসভা একদিন পিছিয়ে দেন শুভেন্দু।